প্রেম এসেছিল নীরবে

সুব্রত দাস, এই দাস পদবী তার জন্মসূত্রে পাওয়া কিনা তা অজানা। কোনো এক শ্রাবনের ঝড়ে এক পাগলী গ্রামের এক নির্জন প্রান্তে শিশুটিকে কুড়িয়ে পেয়েছিল। কয়েকদিন শিশুটিকে সযত্নে রেখে যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াত। এমন এক সকালে এক নিঃসন্তান ভদ্রমহিলা প্রাতঃভ্রমণ করার সময় এক অপরিচিত নোংরা বস্ত্র পরিহিতা মহিলার কোলে শিশুটিকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেলেন। শিশুটিকে জড়িয়ে রেখেছে মহিলাটি। শিশুটির বয়স তেমন বোঝা না গেলেও পা দুটো দেখে মনে হয় ২-৩ মাসের বেশি হবে না। শিশুটির মা যে এই মহিলা নয় তা সহজে বোঝা যায়। মহিলাটির বয়স কম করে হলেও ষাটের বেশি হবে।

এই আগন্তুক মহিলা নিজের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় শিশুটিকে উদ্ধার করে এক অনাথ আশ্রামে রেখে দেন। প্রায় খোঁজ খবর রাখতেন শিশুটির, দিন যায়, শিশুটি পাঁচে পা দিয়েছে। সেই ভদ্রমহিলা নিঃসন্তান হয়েও মাতৃসুলভ মন দিয়ে শিশুটির থাকার স্থায়ী ব্যবস্থা করে দিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে সারা জীবনের বিদায় নিলেন এই ধরা থেকে।

তারপর অনেক কথা, তার জীবনে অনেক বাধা পার হতে হয়েছে সুব্রতকে। স্কুল জীবনে অনেক সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিন্তু ওকে থামিয়ে রাখা যায়নি কেবল তার মেধা ও কর্মকুশলতার দিক। সহপাঠী ছাড়াও আশ্রমের প্রায় সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকাটা তার স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

তারপর কলেজের গন্ডি অতিক্রম করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্পণ করল। সেখানে ও মাথা উঁচু করে পথচলা। তবুও কোথাও যেন পরাজিত সৈনিকের মতো মনে হতো। কারণ কৈশোরে তার পরিচয়টা সে বুঝতে পারেনি, বয়ঃসন্ধি কালে এসে তাকে আঘাত করে। যখন সে একা থাকত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ মানপত্র গুলি চোখ বুলিয়ে দেখে নিত। জীবনে চলার পথে কোনো না কোনো সময় বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়, তাই হয়েছিল সুব্রতর জীবনে।

সেদিন ছিল বৈশাখী পূর্ণিমা। প্রতি বছরের মতো এবছরও বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান সূচীতে ছিল কবিতা, নৃত্য, সঙ্গীত আর ছিল এক বিশেষ আলোচনা সভা। আলোচনার বিষয় ছিল বর্তমান যুব সমাজের কাছে জীবনানন্দ কতটা জনপ্রিয় ? আর সমস্ত অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে ছিল সুব্রত। রাত্রি তখন দশটা। বিচারক মণ্ডলী মূল মঞ্চের বিপরীত দিকে বসে রয়েছে। দর্শক সংখ্যা গত বছরের থেকে বেড়েছে। মাঝে মাঝে দর্শক হাততালি দিচ্ছে। ছোটরা বেলুন নিয়ে খেলা করছে। কোথাও আবার বাজী ফোটানোর আওয়াজ। প্যান্ডেলের মধ্যে কোথাও ফেরিওয়ালা খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করছে। সব মিলিয়ে এক অসাধারণ রাত্তির সম্মুখীন সুব্রত।

হঠাৎ আলো নিভে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব দিকে কিসের চিৎকার, হুড়োহুড়ি পড়ে গেল চারিদিকে। ঠিক সেই সময় কারা যেন এসে জাপটে ধরল সুব্রতকে। টেনে নিয়ে গেল মঞ্চের বাইরে, গায়ে মারও পড়ল সুব্রতর। তারপর কি হল আর কিছুই জানেনা সুব্রত।

অচেতন অবস্থায় কেটেছে কয়েকদিন। যখন তার চেতনা ফিরল চোখ খুলে দেখল কোনো এক নার্সিংহোমের বিছানায় শুয়ে আছে। পাশে বসে আছে চেনা মুখ অতিথি। অনুষ্ঠান সূচীতে তার নাম ছিল। জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’কবিতা আবৃত্তি করবে। বাবা মাকে নিয়ে এসেছিল সেদিন। বাকি বিষয়টা সুব্রতর অজানা।

অতিথির সঙ্গে ব্যাক্তিগত ভাবে আলাপ হয়নি কোনোদিন। সুব্রত কিন্তু সেদিন দেখল খুব আপনজনের মতো পাশে বসতে। ছোট শিশুর মতো চোখে ভরে গিয়েছিল সেদিন। কথা ছিলনা দুজনের মুখে। অতিথি হাতের রুমাল দিয়ে চোখ মুছাতে গিয়ে নিজের চোখের জল গড়িয়ে পড়ছিল। অতিথিকে কাছে পেয়ে সুব্রতও স্বপ্ন দেখছিল। নানা প্রশ্ন জেগেছিল তার মনের মণিকোঠায়। কে এই মেয়েটি, কেনই বা তার পাশে বসে আছে? চার দেয়ালের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার এক অনন্য সুন্দর রোমান্টিকতা অনুভব করছিল সুব্রত। অতিথি পরিস্কার ভাবে বলল –
– ‘কি, এত ভাবছেন’।

উঠে বসবার চেষ্টা করল সুব্রত। কিন্তু তার আগে চোখ পড়ল অতিথির দিকে। পরনে হালকা রঙের গোলাপি শাড়ি, পাশে থাকা রজনীগন্ধার তোড়া, এলোমেলো কেশ ভাগে বকুল ফুলের মালা দিয়ে জড়ানো, কপালে আলতো করে বসানো ছোট গোলাপি টিপ, খোলা জানালা দিয়ে পড়ন্ত বিকেলের শেষ আলোর রেখা পড়েছে শাড়ির ভাঁজে। বড়ই সুন্দর লাগছিল অতিথিকে। অতিথি এমন ভাবে কাছে আসবে তা সুব্রত বুঝে উঠতে পারেনি। আর পারেনি বলেই রোমান্টিকতা ছুঁয়ে যাচ্ছিল একে অপরকে।

অতিথি বলল –
-‘সারাক্ষণ কার কথা ভাবছেন ? আমি তো রয়েছি আপনার পাশে।
সুব্রতর চোখে জল।ছড়িয়ে পড়া আঁচলের এক কোন দিয়ে সুব্রতর চোখ মুছিয়ে দিয়ে অতিথি বলল –
-‘ এমন করে ভেঙে পড়লে আপনার শরীর খারাপ হয়ে যাবে। যাক সে কথা ডাক্তারবাবু বলেছেন আজ আপনার ছুটি করে দেবে। তাই আমি আগেই চলে এসেছি। বাবা মা একটু পরে গাড়ি নিয়ে আসছে’।

এদিকে সন্ধের বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলে উঠল। সেই আলোতে অতিথিকে এক পলকে দেখে নিল সুব্রত। এমন এক সময়ে যৌবনা যুবতীর সন্নিধ্যলাভ সুব্রতর কাছে পরম আনন্দের বিষয় ছিল। এমন সময় নার্সিংহোমের সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। অতিথির মধ্যে বেশ খুশির ভাব। জানালা খুলে দেখে নিল বাবা ও ভাই গাড়ি থেকে নামছে। কিন্তু তখন অতিথির চোখে মুখে এক বিষণ্নতার ছাপ। সে বলল –
-‘এই যে আপনার ছুটি, এবার কোথায় যাবেন বলুন,আপনাকে পৌঁছে দেওয়া হবে সাবধানে থাকবেন কিন্তু’।
সুব্রত ভাবল কোথায় যাব, আশ্রম থেকে এসেছি কতদিন হয়ে গেল। সুব্রত আর কিছু বলতে পারছিল না। এমন সময় অতিথির বাবা এসে ঢুকল। কিছু বলার আগেই সুব্রতকে নিয়ে গাড়িতে উঠল। সুব্রতকে কথা বলার সুযোগ দিচ্ছে না। গাড়ি চলতে আরম্ভ করল। পৌঁছল অতিথির বাড়ি। সুব্রত হয়ে উঠল পরিবারের একজন। অতিথির সংস্পর্শে বেশ ভালোই কাটছিল সুব্রতর দিনগুলি।

সেদিন ছিল ফাগুনী পূর্ণিমা। চাঁদ উঠেছে আকাশে , অন্য দিনের মতো এ-রাত্রিটা বেশ মোহময় লাগছিল। জানালার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় কদম আর বড় অশ্বথের গাছ। ফুলে ভরে গেছে কদম গাছ। আর অশ্বথের ঝুড়ি গুলো মাটিতে নেমে এসেছে। ঘুম নেই সুব্রতর। কাছে পেতে চায় অতিথিকে। এ এক নীরব ভালোবাসা টানছে।

রাত্রি কতটা হবে তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। চোখে ঘুমও আসছে না। এমন সময় খুব হালকা কন্ঠস্বর ভেসে আসছে। হালকা হলেও বোঝা যাচ্ছে কার গলা। অতিথির মা ও বাবা কথা বলছে অতিথির জন্ম পরিচয় নিয়ে। অতিথি মন দিয়ে শুনছিল, শুনছিল সুব্রতও। চাঁদ যে কখন গড়িয়ে পড়ছে পশ্চিম আকাশে তা বুঝতেই পারেনি সুব্রত। হয়তো সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, আর কেউ জেগে নেই। জেগে আছে শুধু সুব্রত। কেবল ছোট একটি কাগজে লিখল –
-‘আমাকে খুঁজো না অতিথি……’।

Leave a comment