লুকোনো স্মৃতি

5ই ফেব্রুয়ারি 2019 রাত্রি তখন ঠিক 9টা ছুঁই ছুঁই । হঠাৎই মোবাইল ফোনের আওয়াজ। বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অন্যমনস্কতাকে সরিয়ে ফোনের দিকে মনোনিবেষ করল। তৎক্ষণাৎ দৌড়ে এসে ফোনটি হাতে তুলে নিল। দেখল অচেনা এক নম্বর। ফোন ধরবে কি ধরবে না এই নিয়ে নিজের মনের ভিতর মতবিরোধ দেখা দিচ্ছিল। কেননা কয়েক দিন আগে এক অচেনা নম্বর থেকে ফোন এসেছিল। ফোন ধরা মাত্রই নিজের ফোনের সমস্ত নথি চুরি হয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে সাইবার ক্রাইম যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এই কথা ভাবতে ভাবতে ফোন কেটে গেল। আবার কিছুক্ষণ পর আবার সেই নম্বর থেকে ফোন বাজল। এই নম্বর হয়ত পরিবারের কারুর চেনা , এইসব কথা ভাবার পরও তার ফোন ধরার প্রতি অনিহা দেখা গেল। সে নিরুপায় হয়ে ফোন ধরল। ফোনটি ধরার সঙ্গে সঙ্গে এক মহিলার কন্ঠস্বর ভেসে এলো –

-‘ভালো আছিস নিলু’।

কন্ঠস্বর চেনা চেনা মনে হলেও সেই মুহূর্তে বুঝতে পারেনি। কার গলা , কে আবার আমাকে এরকম আমাকে সম্বোধন করে। কিছুক্ষণ স্তম্বিত হয়ে থাকার পর কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে উঠল –

-‘কে তুই ; আমি তো বুঝতে পারছি না , দয়া করে বলবি আমায় কে তুই ‘।

এই কথা বলার পর অধির আগ্রহে কান পেতে শুনতে লাগল উত্তর পাওয়ার জন্য।

ফোনের ওপারে মহিলা কন্ঠস্বরটি নিলুর এইরকম প্রত্যুক্তি শুনে নিজেকে সরিয়ে নিল। সে আশা করেনি নিলুর কাছ থেকে এরকম কথা গুলো শুনতে পাবে বলে। মহিলাটি ভেবেছিল অনেকদিন পর কথা হচ্ছে ,নিলু নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে কথা বলবে। কেননা বহু দিনের বন্ধুত্ব।মাঝখানের কয়েক দিনের আমার আচরনে এখনও রেগে রয়েছে নিলু।এই কথা ভেবে ফোন কেটে দিল। নিলু কিন্তু বুঝতে পারেনি যে ফোন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তৎক্ষণাৎ নিলু ও ফোন ব্যাক করলো। কিন্তু কোন লাভ হলো না।তার কারণ মহিলাটির ফোন বন্ধ। তখন থেকে নিলু আরও অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। কেন জানিনা নিজেকে আর স্থির রাখতে পারছে না । সে অধীর আগ্রহে ব্যকুল চিত্তে মুখিয়ে ছিল কখন সে ওই মহিলাটির গলা শুনতে পাবে , ও তার নাম জানবে।

এই কথা ভাবতে ভাবতে রাত কেটে গেল , পরের দিন সকালে নিলু আর একবার চেষ্টা করল যাতে ফোন ধরানো যায়। কিন্তু সেই একই কথা। ফোন রেখে দিয়ে আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। কিন্তু জানতো সে একদিন না একদিন আবার ফোন করবে। কারণ নিলু বুঝেছিল কোনোদিন তার সঙ্গে আমার নিশ্চয়ই পরিচয় ছিল । নিলু জানতো একবার যখন কথা হয়েছে আবার কথা হবে কোনো না কোনোদিন। নিলু সেই প্রতীক্ষায় রইল । প্রতীক্ষা মতো সেইদিন আবার সন্ধ্যায় আবার ফোন এলো। নিলু আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল পরিচয় আগে নেবে।

-‘কে তুমি ? পরিচয় না দিলে আমি কথা বলবো না’।

অপর দিকে মহিলাটি পরিচয় না দিয়ে থাকতে পারলো না। সে নিজের পরিচয় ব্যক্ত করলো নিলুর কাছে।

–‘পরিচয় তো আমি দেব ;তার আগে কয়েকটা কথা বলছি সেটা শুনে তুই যদি বুঝতে পারিস আমি কে।’

মহিলাটি পরিচয় দেওয়ার ঢঙে নিজের বর্ননা করতে লাগল।

–‘মনে আছে তোর আমরা দুজন সেই 2007 সাল থেকে এক সঙ্গে পড়তাম। মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পর দুজনের বিষয় প্রায় একই ছিল , শুধু দুটি বিষয় আলাদা । 2014 সালের প্রথমের দিকে আমি তোকে কিছু বলার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছিলাম কিন্তু ভয়ে আমি বলতে পারিনি’।
এই কথা শুনে নিলু নিস্তব্ধ হয়ে ফোনটি কানে ধরে রেখে শুধু দাঁড়িয়ে থাকল কোনো কথা বলল না। কেন এরকম হল তার ; সে কি আগে থেকেই জানত , নাকি আরো কিছু। নিলু ফোনটি কেটে দিল । দুই হাত মুখে চেপে ধরে নিজের পাতা বিছানায় মুখ নিচু করে শুয়ে পড়ল। নিলু ভাবতে লাগল একি করে হতে পারে যাকে আমি একদিন ফিরিয়ে দিয়েছিলাম , সে আনার আমার কাছে , আমাকে ফোন করছে । নিলু নিজেকে অনেকটা নীচে নামিয়ে নিল।একি হতে পারে , কি ঘটেছিল সেদিন কেনই বা নিলু তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল।

সবে মাধ্যমিক শেষ করে নতুন ক্লাসে ভর্তির আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছে কারণ যেই স্কুলে মাধ্যামিক পর্যন্ত পড়েছে সেই স্কুলে আবার পড়ার জন্য। আবার পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা হই হুল্লোড় আরও অনেক কিছুই। সেই সঙ্গে কৈশোর অতিক্রম করে বয়ঃসন্ধিতে পা , মনকে একজায়গায় রাখার চেষ্টা করলে ও কিছুতেই আর সংযত হয় না। নতুন ক্লাস , নিজেদের মনে কোন এক চাপ থাকলেও পুরোনো বন্ধুবান্ধব পেয়ে সবাই খুশি। ক্লাসে নতুন কিছু মুখও দেখা গেল , যারা অন্য স্কুল থেকে এসেছে। পুরোনো নতুন দের নিয়ে এভাবেই কাটছিল দিনগুলি। আবার মাঝে মধ্যে মনে হতো আর মাত্র দুই বছর , কয়েকটা দিন কেটে গেলে সবাই আলাদা , এই বিষয়টা নিয়ে নিজেরা প্রকাশ না করলেও একটা চাপানোত্তর সৃষ্টি হয়েছিল।

এই ভাবে 5-6 মাস কেটে যাওয়ার পর নিলুর সামনে আকস্মিক ভাবে শ্রুতি নামের এক মেয়ে। নিলু অবশ্য তাকে চিনতো। নিলু ভেবেছিল প্রতিদিনের মতো কোনো সাহায্যের জন্য এসেছে । কিন্তু সেদিনের তার চাউনি ছিল অন্যরকম । নিলু তো অনায়াসে বলে ফেলল –

–‘কী বল ?’

শ্রুতি বলে উঠল —

—‘আজ আমি কিছু সাহায্য চাইতে আসিনি। তোকে কিছু বলতে এসেছি’।
—‘তো বলনা কী অসুবিধা হয়েছে , আমি তো রয়েছি সব সমস্যার সমাধান করে দিচ্ছি’।
—‘আমি তোকে ভালোবাসি’।
এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে নিলুর সারা শরীর শীতল হয়ে এলো। যেন নিথর দন্ডায়মান বৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে থাকল। নিলু ভেবেছিল পাঁচ বছর একই ক্লাসে পড়াশুনা করেছি আমার তো কোনো মনে হয়নি , আর মনে হবার মতো কিছুই নেই , নিজেরা নিজেদের মতো একসঙ্গে মেলামেশা করেছে। নিলু এক মনে কি যেন ভাবছিল। তখন শ্রুতি বলে উঠল —
–‘কি এত ভাবছিস ; কিছু তো বল’।
নিলু যখনই কিছু বলতে যাবে শ্রুতি আবার বলতে আরম্ভ করল —
-‘তুই আজ আর আমায় ফেরাতে পারবি না । তোকে এই কথাটা বলবো বলে কতদিন অপেক্ষা করছি , কিন্তু নিজের মধ্যে সাহস পাইনি। যখন আমরা ক্লাস ফাইভ এ পড়তাম তখন একে অপরকে ভালোভাবে জানি না । যেদিন তোকে প্রথম দেখলাম সেদিন ছিল এক বৃষ্টির দিন। ছাত্র ছাত্রী বেশী না আসার জন্য একসঙ্গে ক্লাস হয়েছিল , আর তুই ক্লাসের মনিটর ছিলি। আর আমি তোকে স্যারের কাছে মার খাইয়েছিলাম। তুই প্রচুর কেঁদেছিলি। প্রথমে রাগের মাথায় আমি আনন্দ পেলেও পরে আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। আর তখন কী ভালবাসা , কী প্রেম কিছুই জানতাম না। শুধু তোকে দেখলে আমার ভালো লাগত।এরপর আর অনেক ঘটনা রয়েছে।তুই আমাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিসনা’।
এই সব কথা শোনার পর নিলু বলে উঠল —
–‘দেখ তোর ধারণাটাই ভুল , আমরা সহপাঠী ভালো বন্ধু ও বলতে পারিস , আর এই সব ভালোবাসা আমি মানিনা। আমার পক্ষে এইসব ভালোবাসা প্রেম করা সম্ভব নয় , আর আমি তোর ভালোর জন্যই বলছি সামনে পরীক্ষা আছে তাতে মন দে। তোকে তো ভালো রেজাল্ট করতে হবে’
আরও বলল —

–‘জানি আমার উপর তোর রাগ হচ্ছে , রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। জানি আমাকে ভুলতে তোর কষ্ট হবে , যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে ভুলে যা , যত তাড়াতাড়ি ভুলতে পারবি তত তাড়াতাড়ি তোর নিজের সাফল্যের দিকে এগোতে পারবি”। এই বলে নিলু ফিরে এলো। শ্রুতি যথাস্থানে দাঁড়িয়ে থাকল।
কয়েক দিন পর পরীক্ষা , পরীক্ষায় মন দিতে চাইলেও কিছুতেই মন বসতে চাইছিল না । কোনো রকমে পরীক্ষা শেষ হলো , যে যার নিজের রাস্তায় পাড়ি দিয়েছে , তবুও শ্রুতি আশায় বুক বেঁধেছিল। রেজাল্টের দিন আবার দেখা হবে। হয়তো বা নিলু সেদিনই তার প্রত্যাশা পূরণ করবে। সেদিন নিলু রেজাল্ট নিতে এলোনা। শ্রুতি রেজাল্ট হাতে দাঁড়িয়েছিল শুধু একবার নীলুকে জানাবে তার রেজাল্ট ভালো হয়েছে । কিন্তু আর বলা হলো না। সেদিনের পর থেকে নিলুর সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হয়নি।

আবার ফোন বাজল , শ্রুতি আর নিজেকে সামলাতে না পেরে বলেই ফেলল আমি শ্রুতি।

–‘তুই কেমন আছিস , অনেক দিন পর নাম্বার জোগাড় করে তোকে ফোন করলাম । এর পরেও তুই আমার সঙ্গে কথা বলবি না’।

পুরোনো বান্ধবীর সঙ্গে কথা হচ্ছে , নিলু বাইরে আনন্দিত হলেও অন্তর যেন ফেটে যাচ্ছে । যাকে একদিন ফিরিয়ে দিয়েছিল সে আবার ফিরে এসেছে । আবার সেই পুরোনো বন্ধুর মতো কথা হয় । কিন্তু শ্রুতি যেন নিজেকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও সে যে আগের নীলুকে পেয়েছে। সময় পেলেই নীলুকে ফোন আর নীলু বসে থাকত কখন সেই পতিক্ষিত গলা শুনতে পাবে।নিলু তার আগের ভুল বুঝতে পেরে ঠিক করেছিল ভুল শুধরে নেওয়ার সময় এসেছে । এবার সে মনস্থির করল সামনে সরস্বতী পূজার দিনই তাকে সেই কথাটা বলবে সে যে কথাটা শুনতে চেয়েছিল , তাকে নীলু ফিরিয়ে দিয়েছিল। দুজনের কথাবার্তায় ঠিক হলো তারা সরস্বতী পূজোর দিন একে অপরকে এক ভালো উপহার দেবে। নীলু ভাবল শ্রুতি হয়তো আমাকে আবার সেই কথাটা বলবে। আবার উল্টো টাও হতে পারে আমি যদি সেই কথা বলি এই যদি আমাকে ফিরিয়ে দেয় । সে যাই হোক আমি বলবোই।

পঞ্চমীর সকালে তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে অঞ্জলীর জন্য রওনা হয় স্কুলের দিকে। সবুজ পাজামা সবুজ পাঞ্জাবিতে নীলুকে খুব সুন্দর লাগছিল। দুজনে একসঙ্গে অঞ্জলী দেবে বলে নীলু অপেক্ষা করতে লাগল। কখন শ্রুতি আসবে আর কখন অঞ্জলী দেবে। স্কুলে অনেক ভিড় ,আর এই ভিড়ে খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল। যতটা সম্ভব খোঁজা যায় ততটাই চেষ্টা করতে লাগল ,কিন্তু পাওয়া গেল না। নিরাশাগ্রস্ত হয়ে একজায়গায় চুপটি করে বসে ভাবতে লাগল। কেমন দেখতে হবে শ্রুতিকে , ওকি সেই আগের মতোই হবে নাকি শরীরের পরিবর্তন ঘটেছে। সে আগে যখন অঞ্জলী দিতে আসত কি অপরূপ সুন্দর লাগত তাকে। যখন শাড়ী পড়তো, চোখে কাজল লাগত, রজনীগন্ধার মালা দিয়ে খোঁপা বাঁধতো, তখন ওকে ফাল্গুনের শুক্লপঞ্চমীতে এক স্বরস্বতীর মতো লাগত ওকে। তাহলে কেন তাকে আমি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। এই সব কথা ভাবতে ভাবতে ক্রমে অঞ্জলী শেষ হতে চলল। এদিকে পুরোহিত মশাই ডাকছে যারা বাকি রয়েছে তাদের অঞ্জলী দেওয়ার জন্য। শ্রুতি আসবেনা ভেবে নীলু বিষণ্ন বদনে মণ্ডপের দিকে এগোতে লাগল। হঠাৎ তার চোখে পড়লো ফুলের সাজি হাতে স্কুলের সেই চিরায়ত নীল পাড়ের সাদা শাড়ী পরে এক মহিলা স্কুলের গেট দিয়ে মণ্ডপের দিকে এগিয়ে আসছে। প্রথম দেখাতে চিনতে না পারলেও মণ্ডপের দিকে এগিয়ে আসতে তাকে চিনতে পারলো।
–‘এই তো শ্রুতি’।
এই আনন্দমুখর অনুষ্ঠানে কেন এমন শাড়ী পরে এসেছে। কোথায় গেল সেই ফুল দিয়ে খোঁপা বাঁধা, কোথায় গেল সেই চোখের কাজল কোনো কিছুই নেই শ্রুতির বদনে। এখন এসব কথা ভাবার সময় নয়, অনেকদিন পর দেখা হয়েছে আগে অঞ্জলী শেষ করি তারপর বাকি কথা। শ্রুতি কাছে আসতেই নীলু বলে উঠল —
–‘চল শ্রুতি আগে অঞ্জলী দিয়ে দিই’।
–‘হ্যাঁ,চল অনেক দেরি হয়ে গেল’।

দুজন একসঙ্গে অঞ্জলী দিল,দেওয়ার পর প্রসাদ খাওয়া শেষ করে একটা নিরিবিলি জায়গায় বসে দুজনে মিলে গল্প করতে লাগল। নীলু যেই বলতে যাবে সেই কথাটি অমনি সেই সময় মা-মা চিৎকার করতে করতে এক বাচ্চা মেয়ে তাদের দিকে দৌড়ে আসছে। নীলু এদিক ওদিক তাকাল কাউকে দেখতে পেল না। সেইখানে কেবল তারা ছাড়া আর কেউ ছিলনা। বাচ্চা মেয়েটিকে দেখে মনে হয় তিন বছরের বেশি হবে না। সেই মেয়েটি দৌড়ে এসে শ্রুতিকে জড়িয়ে ধরল, শ্রুতি তাকে কোলে তুলে নিল। ততক্ষনে নীলু ভারাক্রান্ত মনে পরাজিত সৈনিকের মতো ফিরে আসছে। শ্রুতি যখন চোখ তুলে দেখে নীলু অনেকটা দূরে চলে গেছে। শ্রুতি ডাকল নীলুকে—
–‘নীলু শোন, দাঁড়া তুই, আমার উপহার টুকু নিয়ে যা’।
নীলু পিছন না ফিরে উত্তর দিল —
–‘না থাক, আমি উপহার পেয়ে গেছি’।

———-/—-সমাপ্ত———-/——

লেখা –২৬শা বৈশাখ ১৪২৬
অনলাইন পোস্ট –27/07/2019

Leave a comment